আমি কুয়েট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। আজকে আমি কিছু তথ্য কনফেশন আকারে দিতে চাই। তবে সংগত কারণে কিছু নাম এড়িয়ে যাচ্ছি।
.
নোটঃ ঘটনাগুলো অনেক আগের, যার ফলে সংলাপ বা কথোপকথন হুবহু মনে নাই। যতটুকু মনে আছে শেয়ার করে গেলাম।
.
পার্ট ১:
.
আমার ছাত্রলীগে যোগদানের সাথেও কুয়েটের র্যাগিং জিনিসটা জড়িত। ইমিডিয়েট ব্যাচের ভাইয়েরা র্যাগিং এর সময় আমার এক বন্ধুর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে গায়ে হাত তুলে বসে। সেখানে আমি সামান্য প্রতিবাদ করায় আমার উপরেও নেমে আসে শারিরীক নির্যাতন। মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়াতে বেশ কয়েকটা চড় থাপ্পড় খেয়েও যখন সিনিয়রদের দিকে সরাসরি রাগ নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম, সেটা দেখে অনেকে দমে গেলেও দমে যায়নি সেই ব্যাচের ছাত্রলীগের এক দামাল ছেলে। সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে আরো অনেক চড় থাপ্পড় দিয়ে আমাকে দেখে নেবার হুমকি দেয়। সেইদিন রাতেই সিনিয়ার ব্যাচের নন পলিটিকাল ভাইয়ারা আমাদের ব্যাচের বাকিদের সাথে ঝামেলা মিটমাট করার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং এটা নিয়ে যেনো কোনো বাড়াবাড়ি না হয়, বাইরের কেউ যাতে না জানে, সেদিকে কড়া নির্দেশনা দিয়ে দেয়।
.
আমি এই অপমান হজম করতে না পেরে আমার হলে গিয়ে সেখানকার পলিটিক্যাল লীডারদের কাছে বিচারের জন্য যাই। তারা প্রথমেই আমাকে ছাত্রলীগে যোগদানের জন্য শর্ত দেয় এবং আশ্বাস দেয় যে এটার সমাধান করে দিবে। আমি রাজি হয়ে যাই এবং তার পরের দিনই যে ছাত্রলীগের দামাল ভাই আমাকে সবচেয়ে বেশি চড় মেরেছিলো, আমার কাছে এসে বলে," আরে তোকে দেখেই ত বুঝসিলাম তুই স্যাঠা পাবলিক, রাজনীতি করতে পারবি, তোর মধ্যে মা* আছে। শোন, কিছু মনে করিস না গতকালের ঘটনায়, আর আমার ব্যাচের বাকি যারা তর গায়ে হাত তুলসে, ওরা অনেকেই ছাত্রদল করে। তুই এদেরকে ইজিলি মাইরা দিতে পারবি সামনে।" তখন হলের পলিটিকাল ভাইয়েরা ও আমাদের ২ জনের মধ্যে কোলাকুলি করায় দেয় আর সবাই মিলে বলে যে এখন থেকে যে কোনো প্রবলেমে আমার সাথে থাকবে ওনারা। আমি জিনিসটা নিয়ে আর কিছু করলাম না।
.
এরপর থেকে রেগুলার ছাত্রলীগের মিটিং মিছিলে যাই। এর মধ্যে ১-১ এ ই পলিটিকাল সিনিয়ারেরা বেড শেয়ারিং করে হলে উঠায়ে দেয়। কয়েকদিন পরেই আমার মত ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রলীগের পোলাপানদের ডাক পড়ে পদ্মপুকুরে। বিষয়: ছাত্রদলের কিছু ছেলেদের ডাকা হইসে, ছাত্রলীগের ভাইয়েরা তাদের মারবে। কিভাবে ধরবে, কিভাবে মারবে, কিভাবে পুরো জিনিসটা ম্যানেজ করতে হয় সেটা আমাদের দেখে শিখতে হবে। সেই ছাত্রদলের গ্রুপটার মধ্যে আমাকে মারা এক ভাই থাকাতে আমি অনেক খুশি হয়ে যাই। ছাত্রলীগের ভাইয়েরা (৮-১০ জন) সেই ৪-৫ জনকে প্রথমে চড় থাপ্পড় এবং পরে স্ট্যাম্প দিয়ে কোমড় আর পায়ের মধ্যে বেশ কয়েকটা আঘাত করে। ছাত্রলীগের সেখানে ছিলো [যতটুকু মনে আছে] ১১ ব্যাচের সানী,পংকজ, আবিদ, আরিফ, সৈকত, শীহান, মোনায়েম, বাবলু সহ আরো কয়েকজন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্রদলের সেই গ্রুপটা তেমন কোনো বাধাও দিচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো, নিয়তিকে মেনে নিছেন ওনারা। যা হোক, সবশেষে ক্যাম্পাসে থাকতে হলে ছাত্রদল করা যাবে না, এই মর্মে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলো। এক ভাইয়ের পায়ে বেশ আঘাত লাগাতে তাকে কুয়েট মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো। এটা ছিলো আমার হাতে কলমে প্রথম শিক্ষা।
ফার্স্ট ইয়ারে থাকা অবস্থায় আর তেমন কোনো মেজর ঘটনা নাই। শুধু ১ বার নিজেদের ব্যাচের ছাত্রদল মানসিকতার ছেলেপেলেদের ধরে ভয় ভীতি দেখালাম যাতে ক্যাম্পাসে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখা না যায়।
.
এরপরে ২০১৪ সাল থেকে অবস্থা বেশি খারাপ হয়। আপনারা জানেন, ছাত্রলীগের কাছে পটেনশিয়াল শিবিরের ১ টা সংজ্ঞা আছে। তা হলোঃ
.
"১/ যদি কেউ নামাজ পরে, কিন্তু তাবলীগ করে না,
২/ যদি কেউ দাঁড়ি রাখে, টাখনুর উপর প্যান্ট পরে, কিন্তু পাঞ্জাবি পড়ে না, রেগুলার শার্ট প্যান্ট পরে,
৩/ কারো ফেসবুকে যদি সরকারের সমালোচনা, ভারতের বিরোধীতা এবং পাকিস্তানের সুনাম পাওয়া যায়।“
.
এধরনের কিছু কারো মধ্যে থাকলে তাকে শিবির সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। তো এমন একজনকে পাওয়া গেল যার কাছে তথ্য থাকতে পারে। সম্ভবত সে ছিলো লেদার/ইউআরপি ১৩ ব্যাচের এক নিরিহ ছেলে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই সে বলে দিলো, তার ব্যাচের ২ জনকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়। [ ছেলেটা অতিরিক্ত ভয় পাইসে বলেই এই খারাপ কাজটা করসে বলে আমার ধারণা ] । এই মহামূল্যবান(!) তথ্য প্রদানের জন্য তাকে ছেড়ে দেয়া হলো এবং ওই ২ জন ছেলেকে ডাকা হলো। যাদের নাম বলা হলো, তারা ছিলো লেদার এবং আইইএম ১৩ ব্যাচের ভিন্ন ভিন্ন হলের। [নাম বলতে চাচ্ছি না]।
.
এরপরে নাটকীয়ভাবে ঘটনা শুরু হলো। প্রথমেই আমরা পলিটিকাল যারা সেকেন্ড ইয়ারে আছি, তাদের ডাক পড়লো। আমাদেরকে ধিক্কার দিয়ে সিনিয়ররা বললেন, ”এতদিন আমরা থাকতে কোনো জুনিয়র শিবির করার সাহস পায় নাই। অথচ তোদের জুনিয়ররা শিবির করতেসে আর তোরা কিছু জানোস না। আমাদের কাছে খবর আছে যে ২ টা ছেলে শিবির করে, ওদেরকে হলে আসতে বলা হইসে। ওরা আসলে দেখবি শিবির করা কেম্নে ছুটাইতে হয়।“
.
ঐ ২ টা ছেলে হলে আসার পরে শুরুতেই একটা কাগজ কলম ধরায়ে জিজ্ঞেস করলো, “এই, তোদের সাথে আর কারা কারা শিবির করে, তারা কোন ডিপার্টমেন্ট, কোন হল, কার কি পোস্ট, সব ডিটেইলস এ লেখ। কলম থামলেই খবর আছে।“ ছেলে দুইটা কিছু না বুঝেই একে অন্যের দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। একজন বললো, “ভাই, আমি তো শিবির করি না।” বলার সাথে সাথে ঠাস করে চর মারলো একজন। আরেকজন বলে উঠলো, “আমাদের কাছে সব প্রমাণ আছে, ভোদাই সাইজা লাভ নাই। তোদের একটু পরে পুলিশে দিবো। মাইর না খাইতে চাইলে কাগজে সব ইনফরমেশন লেখতে থাক।” এবার ২ জনই কেঁদে বলতে থাকলো, “ভাই, সত্যিই আমি কিছু জানি না। কোনোদিন শিবির করি নাই, কারা করে তাও জানি না.... ” ইত্যাদি। এর মধ্যেই রুমে রাখা ব্যাডমিন্টন র্যাকেট দিয়ে সজোরে পিটানো শুরু হলো। ২ জনকে পিটিয়ে র্যাকেটের তার ছিঁড়ে ব্যাট পুরাটা বেঁকে গেলো। সেই বাঁকা ব্যাট দিয়ে পেটাতে সমস্যা হওয়ায় র্যাকেট বাদ দিয়ে কোমড় থেকে বেল্ট খুলে তা দিয়ে পেটানো শুরু হলো। এরমধ্যে রুমে চিৎকার শুনে আরো এক ১০ ব্যাচের পলিটিকাল সিনিয়র এসে বললো,” কি ব্যাপার, তোরা শিবির পেটাস কিন্তু এত কম আওয়াজ হয় কেন?”। এই কথা শুনে রুমের সবাই ২ টা ছেলের উপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো। যে যা হাতের কাছে পেয়েছে, তা দিয়েই মাইর। বিশেষ করে বেল্ট, ভাঙ্গা র্যাকেট আর টেপ পেঁচানো চিকন জিআই পাইপ দিয়ে এলোপাথারি মাইর চললো।
.
এক পর্যায়ে আমরা ভাইদেরকে বললাম, “ভাই, এরা মনে হয় শিবির করে না, করলে এতক্ষণে স্বীকার করে নিতো।” ভাই আমাদের হুংকার দিয়ে বললো,” তোরা জানোসই না শিবির কী জিনিস, জান দিয়া দিবে তবুও মুখ খুলবে না।” এবারে ওই যে কাগজ দেয়া হয়েছিল, সেটা আবার ওদেরকে দিয়ে বলা হলো, “তোরা লেখ, আমি অমুক, বাবা অমুক, বাড়ী অমুক, হল, ডিপার্টমেন্ট, আমরা স্বীকার করতেসি যে আমরা ক্যাম্পাসে স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িত। আমরা আজ থেকে আর কখনো এই নিষিদ্ধ সংঘটনের সাথে জড়িত থাকবো না। যদি থাকি, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নেয়া হবে, আমি মেনে নিবো।” ছেলে ২ টা আর কোনো কথা না বলে কোনো মতে কাগজে সেগুলা লিখে জমা দেয়। এরপরে ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় কুয়েট মেডিকেলে। সেখানে বলা হয় যে বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাইসে ২ জন। যদিও সবাই স্পষ্টই বুঝতে পারসে ঘটনা কি। ছেলেগুলোকে রোলেক নামের ১টা ইঞ্জেকশান দিয়ে বিদায় দেয়া হয়।
.
উক্ত ঘটনায় আমি নিজে প্রত্যক্ষভাবে এর সাথে জড়িত ছিলাম। এই ঘটনায় সব মিলিয়ে ১০ ব্যাচের ২ জন, ১১ ব্যাচের ৪ জন, ১২ ব্যাচের ৫ জন জড়িত ছিলো। এরকম আরো ৩ টা ঘটনার সাথে আমি সরাসরি ছাত্রলীগের এমন তাণ্ডবের সাথে জড়িত ছিলাম। এদের অনেকেই এখন বিসিএস ক্যাডার, পুলিশ এবং এনএসআই তে আছে যার কারণে নাম উল্লেখ করতে পারলাম না নিজের নিরাপত্তার খাতিরে। যদি কেউ নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণ করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চান, আমি নাম, ব্যাচ, ঘটনার সময়কাল সহ সবকিছুর প্রমাণ দিতে পারবো।
.
শেষ করবো ঐ ২ টা ছেলের পরবর্তী অবস্থা দিয়ে। দুইদিন পরেই ঐ ২ টা ছেলে ছাত্রলীগে যোগদান করে। হয়তো ভয়ে অথবা সেই কাগজ জমা দেয়ার পরে ইনসিকিউরিটির কারণে তারা ক্যাম্পাসে মোটামুটি এক্টিভ ছিলো। শেষদিন পর্যন্ত দেখে গেসি যে ওরা ওইসব সিনিয়ারদের সব কথা মেনে চলসে। আমার যদ্দূর মনে পড়ে, তারা তাদের হলে ছাত্রলীগের পদও পেয়েছিল।
আমার থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের বাকি ঘটনাগুলোর কনফেশন যদি সুযোগ হয়, তাহলে লিখব।
Note: This story is collected from DSSP-KUET