দি ডেইলি ক্যাম্পাসে প্রকাশিত মাসুদ স্যারের, "আমরা তো সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের ৫টা দাবি মেনে নিয়েছি" মিথ্যাচার এবং '৫ টা দাবি পূরণ না হলে পদত্যাগ চাইতে পারে' বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রসঙ্গে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, আমরা কুয়েটের সকল শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছিলাম, কিভাবে ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে প্রশাসন আমাদের কোনো দফা দাবি না মেনেও, উত্থাপিত ৬ দফার পাঁচটি দাবি মেনে বাস্তবায়নের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল।
আজ ২ মার্চ, ২০২৫, আমরা আবারো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, মাসুদ স্যারের, 'দাবি মেনে নেওয়ার' বক্তব্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
কিন্তু তার আগে আরেকা বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। মাসুদ স্যার বিভিন্ন মিডিয়াতে বলেছেন তার কাছে নাকি প্রথমে শিক্ষার্থীরা তার কাছে পাঁচ দফা নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে পদত্যাগের দাবি নিয়ে যাওয়া হয়। দফাগুলো পেশের একদম শুরু থেকেই আমরা ছয় দফা দাবিই নিয়ে যাই। এমনকি যখন প্রেসব্রিফিং দেওয়া হয় তখনই পদত্যাগের দাবি উল্লেখ করা হয়। আমরা এর বিস্তারিত প্রমাণ (২৬ ফেব্রুয়ারী তারিখের প্রেস রিলিস) সুতরাং আমরা, এই ধরণের মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তু সৃষ্টির তীব্র নিন্দা জানাই।
দাবী ১ প্রসঙ্গে:
আমাদের প্রথম দাবিটি ছিল, "খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অধীনস্থ সকলে কুয়েটের সাথে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় কুয়েটের ভিতরে বাইরে, কোন প্রকার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারবে না, উল্লেখ করে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তি হিসেবে অত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আজীবন বহিষ্কার, শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রত্ব বাতিল বিষয়টি স্পষ্টভাবে উক্ত অধ্যাদেশে উল্লেখ করতে হবে।" নিয়মের ফাঁক-ফোকর যেন না থাকে, আমরা সেই ধরনের স্পষ্টতা চাই অধ্যাদেশে।
মাসুদ স্যার যেই সিন্ডিকেট মিটিং(৯৮ তম সিন্ডিকেট মিটিং) এর কথা বলছেন সেই মিটিং হয়েছিল, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে। মিটিং এর কার্যবিবরণীর (সংযুক্তি ১: ৯৮ তম সিন্ডিকেট মিটিং এর কার্যবিবরণী) প্রথম সিদ্ধান্তে, উল্লেখিত রয়েছে, ৯৩তম (জরুরী) অনুযায়ী স্মারক নং- খুপ্রবি/২৫৯/৬০ তা-১১/০৮/২০২৪ ইং মোতাবেক ঘোষিত রাজনীতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের আদেশটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে। এই লেখাটি শুধুমাত্র পূর্ববর্তী আদেশের পুনরুল্লেখ এবং আমাদেরকে আশা দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
এরপর, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ২০০৩ এর ধারা ৪৪(৫) এর মাধ্যমে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীকে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, রাজনীতির সাথে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা।
এখানে খুব সতর্কভাবে লক্ষ্য করতে হবে, ৪৪ (৫) ধারাটি(সংযুক্তি ২: বিশ্ববিদ্যালয় আইন) শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বিষয়ে একটি শব্দও বলা হয়নি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ শুধুমাত্র স্মারক/একটি আদেশ দ্বারা স্বীকৃত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন দ্বারা স্বীকৃত না।
আমাদের দাবিটি ছিল, অধ্যাদেশের মাধ্যমে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাহিরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, শিক্ষার্থী শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, সকল প্রকার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ করা, যেটি ঐ সিন্ডিকেট মিটিং সহ, পরবর্তী কোনো সিন্ডিকেট মিটিং এ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।
৪৪(৫) ধারা উল্লেখ করে, পরবর্তীতে "এছাড়া" শব্দটি ব্যবহার করে রাজনীতির সাথে জড়িত শিক্ষার্থীদের কথাটি লেখার মাধ্যমে, কুয়েট প্রশাসন দেশবাসীকে 'ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যুক্ত করা হয়েছে' এমন মিথ্যা বার্তা দিতে চেয়েছিল। আমরা পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী প্রশাসনকে সতর্ক করতে চাই, শব্দের খেলা আমাদের সাথে খেলতে যাবেন না।
কুয়েটের নোটিশ/আদেশ এর উপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। ছাত্র রাজনীতি আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ থাকার পরেও, কুয়েটে ছাত্ররাজনীতির অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়। এই নোটিশের পর এই আদেশ বাস্তবায়ন করে, কোনো কর্মচারীর বহিষ্কার কিংবা ছাত্রত্ব বাতিলের ঘটনা আমরা দেখি নাই। যেখানে ফর্ম বিতরণে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ছবি দিয়ে "কুয়েট বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রদল" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এই ঘটনার পরে তারা নিজেরা বিভিন্ন টকশোতেও নিজেদের ছাত্রদল হিসেবে পরিচয় দেয়, সেখানে কুয়েট প্রশাসন থেকে এই সকল চিহ্নিত কুয়েট ছাত্রদল এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পরিশেষে বলতে চাই, যেই নোটিশ আদেশ অথবা রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত থাকা বিষয়ে অধ্যাদেশের কোন বাস্তবায়ন নেই, সেই আদেশ/অধ্যাদেশের অবশ্যই অস্পষ্টতা আছে। তাই আমরা স্পষ্ট অধ্যাদেশ চাই।
দাবী ২ প্রসঙ্গে:
আমাদের দ্বিতীয় দফাটি ছিল মামলার ব্যাপারে। কুয়েট প্রশাসন অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। অথচ আমরা নিজেরাই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করি। তাহলে অজ্ঞাতনামা মামলা কেন করা হয়েছে তার যুক্তিকতা আমরা পাচ্ছি না। জুলাই আগস্টে আমরা দেখেছ কীভাবে অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়ে পরে শিক্ষার্থীদের ফ্রেমিং করে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ধরণের মামলা দিয়ে আমাদেরকে এবং দেশবাসীর চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষতে এ ধরণের মামলা আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। হামলাকারীরা যেখানে বাইরে নির্দিধায় ঘুরাফেরা করছে সেখানে সাধারণ ছাত্ররা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।
আমরা গত ১ মার্চ, ২০২৫ প্রেস রিলিজ এর মাধ্যমে "প্রহসনমূলক তদন্ত কমিটি" নিয়ে কুয়েটের সকল শিক্ষার্থীবৃন্দের স্পষ্ট অবস্থান পরিষ্কার করেছি। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছাড়া, বর্জনকৃত ভিসি দ্বারা নিয়োগকৃত ফ্যাসিবাদী কায়দায় গঠিত উদ্দেশ্য প্রণোদিত, প্রহসনমূলক তদন্ত কমিটিকে আমরা ঘৃণাভরে ভরে প্রত্যাখ্যান করছি এবং তদন্ত কমিটি দ্বারা প্রকাশিত কোন রিপোর্ট কিংবা আদেশ এবং এই তদন্তের প্রেক্ষিতে সিন্ডিকেট মিটিংয়ের কোনো সিদ্ধান্ত আমরা কুয়েটের পাঁচ ব্যাচের কোনো শিক্ষার্থী, কখনোই মেনে নেব না।
দাবী ৩ প্রসঙ্গে:
আমাদের তৃতীয় দফা ছিলো আমাদের নিরাপত্তার দাবি; সামরিক বাহিনীর সহায়তায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছিল। অথচ ক্যাম্পাসে যেই কয়দিন ছাত্ররা ছিলো সেই কয়দিন কোনো নিরাপত্তাই ছিলো না তেমন। এমনকি বহিরাগতরা নিজেদের ইচ্ছামতো ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে এমন কোনো আস্বস্তিও আমরা পাই নাই। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যখন হল ভ্যাকেন্ট করা হলো সেদিন আলাদিনের চেরাগের মতো গেইটের বাইরে অনেক পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়। তাহলে কি ক্যাম্পাস ইচ্ছা করে অনিরাপদ রাখা হয়েছিল যেন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়?
দাবী ৪ প্রসঙ্গে:
চতুর্থ দফা দাবিটি আপাত দৃষ্টিতে মানার চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতিমান হয়। এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করা ভালো যে, বেশিরভাগ আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক খরচ উপস্থিত শিক্ষার্থীরা নিজে থেকেই বহন করে। এমনকি আহতদের জন্য নোটিশ আসতে আসতে আহতরা বেশিরভাগই তাদের অভিভাবকের কাছে চলে যায়। পরবর্তীতে প্রশাসন থেকে আহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা এজন্য প্রশাসনের কাছে কৃতজ্ঞতা পোষণ করছি। তবে আন্দোলনের ১০ দিন পর এসে প্রশাসের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের অবস্থা জানার জন্য হাসপাতালে যাওয়া, এবং আর্থিক সাহায্য দেয়া দেশবাসীকে দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। ১৮ ফেব্রুয়ারী আহত হওয়ার পর থেকে প্রশাসনের মূল লক্ষ্যই ছিলো মাসুদ স্যারকে গদিতে ধরে রাখা, যেজন্য এই দাবীটি মেনে নিতে ১০ দিন সময় লেগেছে। রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ সমবেদনা থাকলে আজ একপাশে একত্রে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রসাশনের বিরুদ্ধে দাড়ানো লাগতো না।
দাবী ৫ প্রসঙ্গে :
পঞ্চম দফা ছিলো কুয়েটের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিবৃতি দেওয়া যে, এই হামলা ছাত্রদল কতৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর করা হয়েছে। সারাদেশে এই হামলাকে নিয়ে অনেক ট্যাগিং হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনাকি আহতদের হেনস্তা করা হয়েছে। এসব ট্যাগিং এবং ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্যও এই বিবৃতি অত্যন্ত জরুরী ছিল। কিন্তু ১৮ তারিখের ঘটনায় জড়িত থাকায় বিএনপি নিজেদের দলের বহিষ্কারের পরেও আমরা কুয়েট এর পক্ষ থেকে কোনো ধরণের বিবৃতি দেখি নাই। ঘটনার দশদিন এর মাঝে উনারা সব দেয়ালিকা মুছে দিয়েছে, হল ভ্যাকেন্ট করে দিয়েছে, অথচ কোথাও একটি বিবৃতও দিতে পারলো না। কিন্তু মিডিয়াতে পাঁচ দফা মানার মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এমন শিক্ষার্থীবিরোধী মিথ্যাচার জুলাই আগস্টের পরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দাড়া হয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই।
উপরোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো একটি দলকে শেল্টার দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। এতকিছুর পরেও ভিসি স্যার নিজের ব্যর্থতার দায় নিতে চাচ্ছে না। প্রশাসনিক ভবন বন্ধ থাকার পরেও ভিসির বাসভবনেই একের পর এক এক্সিকিউটিভ ডিসিশন নিয়ে যাচ্ছে। তাকে আমরা কেন ভিসি হিসেবে মানবো?
আরেকটি বিষয় মাসুদ স্যার বলতে চাচ্ছেন, যদি ৫ দফা পূরণ না হয়, তাহলে ৬ নং দফা এর প্রসঙ্গ আসবে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, ৬নং দফা এর স্বতন্ত্র কারণ রয়েছে। ৬নং দফা কোনভাবেই ৫ দফা পূরণের উপর নির্ভরশীল না। ৬ নং দফা এর কারণসমূহ আমরা স্বারকলিপিতে উল্লেখ করেছি, এখানে আবারো জানিয়ে দিচ্ছি :
১. রাজনীতি নিষিদ্ধ কুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি অনুপ্রবেশের অপচেষ্টার সাথে জড়িত থাকা।
২. ১৮-০২-২০২৫ তারিখে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কর্তৃক আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া।
৩. প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার পরও ব্যর্থতার দায় নিতে অস্বীকার করা।
৪. যথোপযুক্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, চিহ্নিত কুয়েট ছাত্রদল এবং স্থানীয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে স্বীকার না করা।
৫. ভিসির কাছে উক্ত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রদানকৃত ৬ দফা দাবি পূরণের পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার পরও ৬ দফা দাবি সম্পূর্ণরূপে মেনে না নেওয়া।
আমরা আবারো মাসুদ স্যার ও কুয়েট প্রশাসনকে সতর্ক করছি, পতিত স্বৈরাচারের ব্যর্থ কৌশল গুলো গ্রহণ করবেন না, আমাদের সাথে মিথ্যাচার লিপ্ত হবেন না। আমরা আপনাদের যেকোনো ধরনের মিথ্যাচার করার অপচেষ্টা রুখে দিব।
সকল শিক্ষার্থীবৃন্দ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়